গোপাল ভাঁড়কে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা

গোপাল ভাড় বলতেই এইটি হাস্যকর চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, টাক মাথা, পেট মোটা একটু বাটু করে একজন ফুরফুরে মেজাজের লোক যার প্রতিটি কথা মানুষের মনে আনন্দ যোগায়। গোপাল ভাড় কে আমরা প্রায় সকলেই চিনি,  এই চরিত্রটি আরো বেশি পরিচিতি লাভ করেঠে ভারতীয় একটি কমার্শিয়াল টিভি চ্যানের সনি আট এ প্রচারিত তাকে কেন্দ্র করে প্রচারিত গোপাল ভার কাটুন শোটির জন্য।



গোপাল ভাঁড় ছিলেন মধ্যযুগে নদিয়া অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত রম্য গল্পকার, ভাঁড় ও মনোরঞ্জনকারী। তাঁর আসল নাম গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়া জেলার প্রখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় নিযুক্ত ছিলেন, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা ও জনগণের যাবতীয় বিনোদনের আস্ত এক ভাণ্ডার ছিলেন বুদ্ধিমান গোপাল।

 রাজা তাঁকে তাঁর সভাসদদের মধ্যকার নবরত্নদের একজন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই আমলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদের সামনে নির্মিত তাঁর একটি ভাস্কর্য এখনো সেখানে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর পৌরসভার সীমানায় ঘূর্ণীতে গোপাল ভাঁড়ের নতুন মূর্তি স্থাপিত হয়েছে।

প্রায় দুইশত বছরেরও অধিক আবহমানকাল ধরে প্রচলিত তার জীবন-রস সমৃদ্ধ গল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে, লোককথায় এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে। কতগুলি গল্প প্রায় প্রবাদের ন্যায় ব্যবহৃত হয়। তাকে মোল্লা নাসিরুদ্দিন ও বীরবলের সমতুল্য হিসাবে পরিগণনা করা হয়।

গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ঐতিহাসিক, গবেষক ও ভাষাবিদদের কাছে বিতর্কের বিষয় বহুকাল থেকে। গোপালের গল্পগুলি সমাজে চুড়ান্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত হলেও গোপাল ভাঁড় বাস্তবে ছিলেন কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকেই মনে করেন গোপাল ভাঁড় নামে কেউ নির্দিষ্ট করে ছিলেননা। তবে কোনো না কোনো বিদূষক রাজার প্রিয়পাত্র হন। সেরকম গোপাল নাম্নী নাপিত বংশীয় কোনো ব্যক্তি ছিলেন। গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে তা কোথাও লেখা নেই। তার জন্মস্থানের পক্ষেও কোনো নথি নেই, কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে তার সম্পত্তির কিংবা জায়গা-জমির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। গোপালের বাবার নাম জানা গেলেও তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। নগেন্দ্রনাথ দাসের মতে গোপালের পদবী ছিল 'নাই'। মহারাজ তাকে হাস্যার্ণব উপাধী দান করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছেন ‘গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি, গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’-জাত মনে করে অনেক গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তি যাই হোক, গোপাল ভাঁড় বাঙালি রসিক ও লৌকিক সংস্কৃতিতে অমলিন হয়ে আছেন।

বাংলায় যে প্রবাদ বাক্য গুলো এসেছে তা মূলত বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসেছে। বাংলার একটা প্রচলিত কথা হল অতি চালাকের গলায় দড়ি। গোপাল একজন অতি চালাক ও বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন আর প্রচলিত কথা অনুসারে অদ্ভুত ভাবে মিলে গেল এই প্রবাদ বাক্যটি, ফাঁসি শাস্তি দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হলেছিল এই চালাক ও বুদ্ধিমান মানুষটিকে। এত প্রিয় মানুষ হয়েও বাংলাতে তার ঠাঁই হয়নি; বরং দেয়া হয়েছিল ফাঁসির আদেশ! গোপাল ভাঁড়কে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা।

তখন ছিল ১৭৫৭ সাল। তরুণ সিরাজ-উদ-দৌলা ওই সময়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ), বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, জগৎ শেঠ, রায় দূর্লভ, উমিচাঁদসহ অনেকেই নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই তাদের হীনস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করেন। ঠিক ওই সময় কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাব বিরোধী এই ভয়ংকর বলয়ে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের এই পরিকল্পনায় রাজসভার সবাই সমর্থন করলেও শুধু একজন ব্যক্তি ‘না’ করলেন। আর তিনি হলেন গোপাল ভাঁড়।

বাংলার এমন সর্বনাশ না করতে গোপাল বারবার অনুরোধ করলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। কিন্তু রাজা তার কথায় কর্ণপাত করলেন না বরং তার সভাসদদের নিয়ে গোপালকে বিদ্রুপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে বিভিন্ন সময় বুদ্ধি পরীক্ষা দিতেন, এই সময়ও অনেকটা তাই ঘটলো, শর্ত দিলেন, গোপাল যদি নবাবকে মুখ ভেংচি দিয়ে আসতে পারে তবেই তিনি নবাবের বিরুদ্ধে যাবেন না।

কৃষ্ণচন্দ্রের শর্ত শুনেই গোপাল হাঁটা শুরু করলেন মুর্শিদাবাদের দিকে। কিন্তু তাকে ভাগিরথী নদীর তীরে গড়ে ওঠা হীরাঝিল প্রাসাদে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না কিছুতেই। গোপাল বুদ্ধি করেই এক প্রহরীর হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন। ফলশ্রুতিতে বিচারের জন্য নবাবের কাছে নেয়া হলো গোপালকে।

পুরো ঘটনা শুনে নবাব বললেন, ‘তুমি কে, কেন এসেছো?’ গোপাল কোনো কথা না বলে নবাবকে মুখ ভেংচি দিলেন। নবাব রেগে গোপালকে আটক করলেন। বললেন, আগামীকাল তোমার বিচার হবে।

এরইমধ্যে গোপাল মীরজাফরকে চুপি চুপি বললেন, ‘আমি এসেছিলাম তোমাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে। কিন্তু কিছু বলবো না। কারণ এসব কথা ফাঁস করে দিলে কৃষ্ণচন্দ্রও ফেঁসে যাবে। নবাব তাকে সরিয়ে অন্য জনকে ক্ষমতায় বসাবেন। আমি চাই না কৃষ্ণচন্দ্র তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলুক। তিনি যে আমার অন্নদাতা।’

মীরজাফর তার এমন কথা শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন। মীরজাফর চক্রান্ত করে গোপালের ফাঁসির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু গোপালের মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। নবাব গোপালের মুখের দিকে তাকাতেই গোপাল আবারো ভেংচি দিলেন। এবার নবাব রীতিমতো ভাবনায় পড়ে গেলেন।

নবাব ভাবলেন, এ তো পাগল! তাকে ফাঁসি দেয়া ঠিক হবে না। নবাব গোপালকে মুক্ত করে দিলেন।

দেশপ্রেমিক গোপাল ফিরে এলেন কৃষ্ণনগরে। যখন জানতে পারলেন কৃষ্ণচন্দ্র তার সিদ্ধান্তে অটল গোপাল ঠিক করলেন রাজসভায় আর যাবেন না। এমনকি রাজ্যেই আর থাকবেন না। অত্যন্ত ব্যথিত মন নিয়ে কাউকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে পরিবার নিয়ে রাজ্য ত্যাগ করলেন গোপাল ভাঁড়। এরপর থেকে সদা হাস্যময় গোপাল ভাঁড়কে বাংলায় আর দেখা মেলেনি।