দ্বারকা: সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন

দ্বারকা: সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীন নগরী


আরব সাগরের তীরে এবং উপকূল উভয় দিকেই, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছে। ১৯6363 সালে জমিতে প্রথম তদন্তে অনেক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল। জনবসতিগুলি বহির্মুখী এবং অভ্যন্তর প্রাচীর এবং কেল ঘাঁটি আকারে। নোঙ্গরগুলির টাইপোলজিকাল শ্রেণিবিন্যাস থেকে অনুমান করা হয় যে দ্বারকা বন্দর হিসাবে ভারতের মধ্য রাজ্যগুলির সময়কালে উন্নত হয়েছিল। উপকূলীয় ক্ষয় সম্ভবত একটি প্রাচীন বন্দর যা ছিল ধ্বংসের কারণ ছিল।

 বর্তমানের দ্বারকা ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটের একটি জেলা।এটি গোমতী নদীর ডান তীরে ওখামণ্ডল উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। দ্বারকা প্রায়শই দ্বারকা কিংডম, কৃষ্ণের প্রাচীন রাজ্য, এবং এটি গুজরাটের প্রথম রাজধানী বলে বিশ্বাস করা হয়।

 দ্বারকা শব্দেরদ্বারঅর্থ দরজা আরকাঅর্থ স্বর্গ কিংবা মোক্ষ। সে অর্থে দ্বারকা মানেস্বর্গের দ্বারকিংবা মোক্ষ লাভের উপায়। এছাড়াও দ্বারকা ভারতের সপ্তপুরী নামে পরিচিত সাতটি বিখ্যাত প্রাচীন শহরের একটি। এটি এখানে অবস্থিত ৮০০ বছর পুরানো ৫৭ মিটার উঁচু কৃষ্ণ মন্দিরের জন্য বেশ পরিচিত। তবে বর্তমানের এই দ্বারকা শহর মূলত হিন্দু ধর্মের দেবতা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন নগরীর জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ, যা একসময় ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রের নিচে।

 পৌরাণিক নগরী দ্বারকার কথা প্রাচীন ভারত হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান মহাকাব্য মহাভারত সহ ভগবত গীতা, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, হরিবংশ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দ্বারকা হলো সেই প্রাচীন শহর যেখানে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণ একসময় বাস করতেন। বিভিন্ন সূত্রানুসারে শ্রীকৃষ্ণ বর্তমান ভারতের দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত উত্তর প্রদেশের মথুরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

  কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তৎকালীন মথুরার অত্যাচারী রাজা। পরবর্তীতে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। ফলে খবর শুনে কংসের শ্বশুর, মগধের রাজা জরাসন্ধ রেগে যান এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ১৭ বার মথুরা আক্রমণের পরও জরাসন্ধ মথুরা জয় করতে ব্যর্থ হন। তবে এই ১৭ বার আক্রমণে মথুরার অধিবাসী যাদবরা দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষ্ণ যখন বুঝতে পারেন জরাসন্ধ আর একবার আক্রমণ করলে তারা আর তা প্রতিরোধ করতে পারবেন না, তখন তিনি তার লোকদের নিয়ে মথুরা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।

মথুরা ত্যাগের পর কৃষ্ণ নতুন এক শহর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। প্রথমটির মতে কৃষ্ণ গরুড়ে (কৃষ্ণের বাহন) চড়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমের সাউরাস্ট্রে আসেন এবং সেখানে দ্বারকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় কাহিনী অনুসারে নতুন এই শহর প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণ নির্মাণের দেবতাবিশ্বকর্মারসাহায্য নেন। বিশ্বকর্মা কৃষ্ণকে জানান, যদি সমুদ্রের দেবতাসমুদ্রদেবতাদেরকে কিছু জমি প্রদান করেন শুধুমাত্র তবেই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কৃষ্ণ তখন সমুদ্রদেবের পূজা করেন এবং সমুদ্রদেব খুশি হয়ে কৃষ্ণকে ১২ যোজন (৭৭৩ বর্গ কি.মি.) জমি প্রদান করেন। জমি পাওয়ার পর বিশ্বকর্মা সেখানে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন।

পুরাণকালে বৈদিক ভারতীয়রা দ্বারকা সৌরাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মথুরা থেকে চলে আসা যাদবগণ এখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যখন শহরটি "কৌশালি" নামে পরিচিত ছিল। এই সময়েই এই শহরটির পুনর্নির্মাণ হয় এবং এর নামকরণ করা হয় দ্বারকা

 

দ্বারকা নগরীর নকশা বিবরণ

মহাভারত অনুযায়ী দ্বারকা ছিল শ্রীকৃষ্ণ তথা যদুবংশীয়দের রাজধানী। খুব ভালোভাবে পরিকল্পনা করেই দ্বারকা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরো শহরটি মোট ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল। আবাসিক বাণিজ্যিক এলাকা, চওড়া রাস্তা, নগরচত্বর, সোনা, রূপা দামী পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল বিশাল প্রাসাদ, জনগণের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা স্থাপনা সহ নানা উদ্যান লেক ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছিল দ্বারকা নগরী। প্রায় লক্ষ ছোটবড় প্রাসাদ ছিল নগরীতে। এখানে ছিলসুধর্ম সভানামের এক বিশাল হলঘর, যেখানে নানা ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। গোটা নগরীটি ছিল জলবেষ্টিত। এটি ছিল মূলত একটি দ্বীপ-নগর। চারপাশে বেষ্টিত জলরাশি দ্বারকাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতো। দ্বারকা নগরী ছিল দুভাগে বিভক্ত। একটি মূল দ্বারকা নগরী অন্যটি দ্বীপ-দ্বারকা, যা মূলতবেট-দ্বারকানামেই বেশি প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী এই দুই দ্বারকার মাঝে ছিল অগভীর সমুদ্র। মূল অংশের সাথে দ্বীপ শহরটি নানা ব্রিজ বন্দর দ্বারা যুক্ত ছিল। জোয়ারের সময় মূল দ্বারকা থেকে দ্বীপ দ্বারকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আবার ভাটার সময় যুক্ত হয়ে যেত দুটি। কৃষ্ণ তার বাকি জীবন দ্বারকা নগরীতেই অতিবাহিত করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি ভাল্কা তীর্থের এক বনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দুর্ঘটনাবশত এক শিকারীর তীর বিদ্ধ হয়ে নিহত হন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর গোটা দ্বারকা নগরী এক বিশাল বন্যায় সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যায়।

 n 200 খ্রিস্টাব্দে, দ্বারকের দ্বিতীয় রাজা বাসুদেব মহাক্ষত্রিয় রুদ্রদমাকে পরাজিত করেছিলেন। রুদ্রদমার মৃত্যুর পরে, তাঁর স্ত্রী, রানী ধীরাদেবী তার ভাই পুলুমাভিকে আমন্ত্রণ করেছিলেন, শাসনের নির্দেশনা চেয়েছিলেন। রুদ্রদম বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং দ্বারকায় কৃষ্ণের পূজা করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি বজ্রনাভ একটি ছত্রি (একটি ছাতার ধরণের স্মৃতিস্তম্ভ) তৈরি করেছিলেন এবং তাতে কৃষ্ণের একটি মূর্তি দেবদেব করেছিলেন। 

আদি শঙ্করাচার্য দেশের চার কোণে প্রতিষ্ঠিত চারটি ধামের মধ্যে একটি (ধর্মীয় আসন) সন্ন্যাস কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি দ্বারকা মন্দির কমপ্লেক্সের অংশ হিসাবে গঠিত। 885 খ্রিস্টাব্দে, মন্দিরটি শঙ্করাচার্য পিঠের (কেন্দ্র) প্রধান নৃশিনহাশ্রমা সংস্কার করেছিলেন। 1241 সালে, মোহাম্মদ শাহ দ্বারকা আক্রমণ করেছিলেন এবং মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিলেন।

এই যুদ্ধের সময়, পাঁচ জন ব্রাহ্মণ (বিরাজী ঠাকর, নাথু ঠাকর, করাসন ঠাকর, ভালজী ঠাকর, এবং দেবসী ঠাকর) তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, মারা গিয়েছিলেন এবং শহীদ হিসাবে সম্মানিত হন।

1473 সালে গুজরাত সুলতান মাহমুদ বেগদা শহরটি দখল করে দ্বারকা মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলেন। জগৎ মন্দির বা দ্বারাকাধিস মন্দিরটি পরে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।

বল্লভ আচার্য দ্বারকাধিশের একটি মূর্তি পুনরুদ্ধার করেছিলেন,  মুসলিম আক্রমণের সময় তিনি লাডভা গ্রামে যাওয়ার আগে এটি একটি স্টেপওয়েলে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যা সাবিত্রী ভাভ নামে পরিচিত।1551 সালে, যখন তুর্কি আজিজ দ্বারকা আক্রমণ করেছিলেন, প্রতিমাটি বেত দ্বারকা দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।


* তথ্যসুত্র: উইকিপিয়া ও  বিভিন্ন ওয়েবসাইট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন